মোদীর সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের গল্প আর ব্রাক্ষণত্ববাদী কর্পোরেট মিডিয়ার নির্লজ্জ দালালি

শনিবার, অক্টোবর ০১, ২০১৬ 0 Comments A+ a-



২৯ সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার, ভারতের সেনাবাহিনীর মহাপরিচালক (অপারেশন) রণবীর সিংহ এক সাংবাদিক সম্মেলনে মোদী সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করেন  যে ভারতের সেনাবাহিনীর একটি টিম নাকি বুধবার মধ্যরাতের সাড়ে ১২টা থেকে ভোর সাড়ে ৪টা পর্যন্ত কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখা পার করে কয়েক কিলোমিটার এলাকার ভিতরে কিছু জঙ্গী “লঞ্চপ্যাডে” সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করে এমন জঙ্গীদের খতম করেছে যারা নাকি কিছুদিনের মধ্যেই নিয়ন্ত্রণ রেখা পার করে ভারতের সেনা ঘাঁটির উপর আবার উরির কায়দায় হামলা করার পরিকল্পনা করছিল। এর সাথে সাথে রণবীর সিংহ বলেন  যে এই আক্রমণে ভারতের সেনাবাহিনীর হামলায় ৩৫ জন জঙ্গী ও তাদের সমর্থকের মৃত্যু হয়েছে এবং এই সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের খবর রণবীর সিংহ টেলিফোন করে পাকিস্তানের সেনা কর্তাদের নাকি জানিয়েছেন।রণবীর সিংহ বলেন যে ভারতের সেনাবাহিনীর কাছে নাকি গোপন সূত্রে পাওয়া পাকা খবর ছিল যে এই সব সন্ত্রাসবাদীরা নিয়ন্ত্রণ রেখা পার করে হামলা করতে আসছিল।

সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের এই বিবৃতি প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই মোদী ভক্তদের উল্লাসের বাঁধ ভেঙে যায়।এই সাংবাদিক সম্মেলনের পর থেকেই কর্পোরেট পাবলিক রিলেশন্স বা জন সম্পর্ক অভিযানের মতন ভারত সরকার ও বিজেপি নিজেদের পিঠ চাপড়াতে থাকে। সারা দেশজুড়ে কর্পোরেট সংবাদ মাধ্যমগুলো নানা ভাষায় আর নানা ভাবে মানুষ কে বোঝাতে থাকে কি ভাবে ভারতের সেনা বাহিনী এমন এক দুঃসাহসিক অভিযান করে পাকিস্তানের দখলে থাকা এলাকার ভিতরে ঢুকে জঙ্গী হত্যা করে ভারতের স্বার্থ কে সুরক্ষিত করেছে। চতুর্দিকে শুধু মোদীর জয় জয়কারে আকাশ বাতাস ভরে গেল। বিজেপির নেতারা বুক বাজিয়ে বলতে থাকলো যে “বলেছিলাম না, মোদীর ভারত চুপচাপ আক্রমণ সহ্য করবে না”, মোদী কে হিন্দু ভারতের সর্বাধিনায়ক রক্ষাকর্তা হিসেবে চিহ্নিত করে টুইটার জুড়ে তার প্রশংসার ঝড় বইয়ে দেয় অমিত শাহ থেকে শুরু করে সমস্ত রাজনৈতিক নেতারা।মোদী প্রশংসার এই বন্যায় সংসদীয় বাম-ডান-মাঝখানের সব বিরোধীরাও  ভেসে যায়  দুই হাত তুলে মোদী সরকারের জয় জয়কার করে। কর্পোরেট মহল ভারতের সেনার সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের প্রশংসা করে উচ্চগ্রামে। আনন্দ মাহিন্দ্রা থেকে কিরণ শাও মজুমদার, সকলেই মোদী সরকারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বিজেপির পদক্ষেপের প্রতি নিজেদের সমর্থন জানান দেয়। ভারতের কর্পোরেট দুনিয়ার সমর্থন পেয়ে আরও আহ্লাদে আটখানা হয়ে পড়ে মোদী সরকার ও বিজেপি। জোর কদমে ঢাক বাজতে থাকে।কর্পোরেট মিডিয়ায় রক্ত পিপাসু কিছু লোক, যারা বেশ কয়েকদিন ধরে পাকিস্তানের রক্ত চাই, রক্ত চাই, বলে চিৎকার করছিলো, তারাও এই ঢাকে কাঠি দিল আর সাথে সাথে যে সকল সংবাদ মাধ্যম এতদিন মধ্যপন্থায় গিয়ে বলছিলো যে যুদ্ধ নয় কূটনৈতিক ভাবে পাকিস্তানের উপর চাপ বাড়াও, তারাও সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের খবর শুনে ধেই ধেই করে নেচে উঠলো। সমগ্র দেশের সংবাদপত্রের পাতা জুড়ে, টিভির পর্দা জুড়ে, রেডিও, ইন্টারনেট আর সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে শুধুই সার্জিক্যাল স্ট্রাইক। মনে হলো যদি দেশের কিছু নিয়ে গর্ব করার থাকে, তাহলে তা হলো সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, যদি ভারতের সর্ব শ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব বলে কিছু থাকে তাহলে নিঃসন্দেহে তা হলো সার্জিক্যাল স্ট্রাইক।  

তবু অনেকগুলো ফাঁক রয়ে গেছে সামরিক বাহিনীর মহাপরিচালক (অপারেশন) রণবীর সিংহের বক্তব্যে, যা নিয়ে আমাদের দেশের শাসকশ্রেণীর বশংবদ সংবাদ মাধ্যম কোনোদিন মাথা ঘামাবে না বা প্রশ্ন তুলবে না।অথচ সত্য কে জানার জন্যে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া ভীষণ জরুরী। প্রশ্ন তোলার অধিকার একটা গণতান্ত্রিক দেশের সমস্ত নাগরিকের আছে, আর দেশপ্রেম বা জাতীয় সুরক্ষার নামে যদি দেশলাইয়ের বাক্স থেকে রিকশার টায়ার কেনার মাধ্যমে যে জনগণ কর দিচ্ছে তাঁরা জানতে না পারেন যে তাঁদের টাকা সরকার কি ভাবে অপচয় করছে, তাহলে সুনিশ্চিত হতে হবে যে ডাল মে কুছ কালা হায়।

ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থা বিবিসি জানিয়েছে যে ভারতের সেনাকর্তার এই সাংবাদিক সম্মেলনে কোনো সাংবাদিক কে প্রশ্ন করতে দেওয়া হয়নি। ভারতীয় সেনার ডিজিএমও রণবীর সিংহ এই তথাকথিত সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের পক্ষে কোনো বিশ্বাসযোগ্য  প্রমাণ বা নথি পেশ করেননি, জানিয়েছেন যে উপযুক্ত সময়ে ভারতীয় সেনা এই নথি প্রকাশ করবে। কোন জঙ্গী সংগঠনের উপর হামলা করা হলো, কি করে জানা গেল যে তারা জঙ্গী ঘাঁটিতেই হামলা করেছে, বা কোথায় কোথায় এই হামলা করা হলো তার কোনো তথ্যই এই সাংবাদিক সম্মেলনে পেশ করা হয়নি। এই সাংবাদিক বৈঠকের পরে ভারতের সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের খবর ছড়িয়ে পড়তেই পাকিস্তানের সরকার ও সেনাবাহিনী সোজাসুজি এমন কোনো আগ্রাসনের খবর অস্বীকার করে জানায় যে ভারতের তরফ থেকে বুধবার ভয়ানক গোলা বর্ষণ করা হয় এবং এর ফলে তাদের দুই জন সৈন্য মারা গেছে। সেই গোলাবর্ষণের ঘটনাকে যদি ভারতের সেনা বাহিনী সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের গল্পের সাথে গুলিয়ে ফেলতে চায় তাহলে সেটা হবে ভারতের শাসকশ্রেণীর দেউলিয়াপনার নিদর্শন,  তবে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলো এই তথাকথিত “সার্জিক্যাল স্ট্রাইক” ঘটনাটি কে সেই রকম গুরুত্ব দেয়নি যা সাধারণতঃ ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে কোন সংঘর্ষ পেয়ে থাকে। এই হালকা ভাবে দেখাটাও অনেকের চোখে সন্দেহজনক মনে হচ্ছে।

আমরা আগেই একটা শংকা প্রকাশ করেছিলাম যে যদিও ভারতের মোদী সরকার একটা জঙ্গী হিন্দুত্ববাদী সরকার এবং প্রতিবেশী দেশ ও কাশ্মীর সহ অন্যান্য জাতিসত্তার বিরুদ্ধে আক্রমণ করার অভিপ্রায় এই সরকারের রন্ধে রন্ধে, তবুও যতদিন না মার্কিন দেশের নির্বাচন শেষ হচ্ছে ততদিন ভারতের বা পাকিস্তানের পক্ষে কোনো রকম বড় ধরণের সামরিক অভিযান করা সম্ভব নয়, কারণ এই দুই সরকার যে মার্কিন শাসক শ্রেণীর গোলামি করে তারা এই মুহূর্তে যেন তেন প্রকারে হিলারি ক্লিন্টন কে জিতিয়ে রাষ্ট্রপতি করে গরিব আমেরিকানদের ধাপ্পা দিতে বিস্তর পরিশ্রম করছে। ভারত ও পাকিস্তানের মাঝে যুদ্ধ হলে মার্কিন সরকারকে, যে সরকার এখন ওবামার নেতৃত্বে সেই ডেমোক্র্যাটদের হাতেই রয়েছে, একটা পক্ষ নিতেই হবে - যা নিঃসন্দেহে ভারতের পক্ষে যাবে কারণ ভারতের বাজার ও খনিজ সম্পদের ভাণ্ডার পাকিস্তানের চেয়ে বেশ বড় এবং অনেক বেশি করে একচেটিয়া পুঁজির উপযোগী। আর এই ভাবে যদি ডেমোক্র্যাট সরকার কে পাকিস্তানের বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিকেরা সরাসরি ভারতের পক্ষে ঝুঁকতে দেখে তাহলে তারা হয়তো হিলারিকে ভোট দিতে ইতস্তত করবে, যা ডেমোক্র্যাটদের ডোনাল্ড ট্রাম্পের জূজূ দেখিয়ে যে মুসলমান ভোটের মেরুকরণ করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, তাতে জল ঢেলে দেবে। ফলে এই বছরের নভেম্বর অবধি লাগাম ধরে রাখার নির্দেশ নয়া দিল্লি ও ইসলামাবাদে এসেছে হোয়াইট হাউস থেকে। তাই উরিতে জঙ্গী হামলার পরেই এক সময়ে পাকিস্তান কে উপযুক্ত ভাষায় জবাব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া নরেন্দ্র মোদীও গুটিয়ে গেছিল ও কেরলের কোঝিকোডে অশিক্ষা, দারিদ্র্য, অপুষ্টি দূর করার যুদ্ধের কথা বলে বা কখনো ইন্দাস নদীর  জলবণ্টন চুক্তি খারিজ করা বা পাকিস্তান কে দেওয়া মোস্ট ফেভারড নেশন এর তকমা সরিয়ে দেওয়ার কথা বলে  হাওয়া ঘোরাবার চেষ্টা তাকে করতে হয়। কিন্তু মোদীর ম্যানেজার’রা বুঝেছিল যে এই সব জবাবে বিজেপির পাঁড় সমর্থকেরা, উঁচু জাতের ধনী ও উচ্চ মধ্যবিত্ত হিন্দুরা কোনো ভাবেই সন্তুষ্ট হবে না এবং এর ফলে হয়তো উত্তর প্রদেশের নির্বাচনে সমর্থন খোয়াতে হতে পারে। ফলে একটা সাপ মেরে লাঠি অক্ষত রাখার পথ খুঁজে পাওয়ার দরকার ছিল গেরুয়া শিবিরের কাছে।

মার্কিন দেশ থেকেই পথ বাতলানো হলো। কথা হলো মোদীর প্রিয় পাত্র ও আরএসএস এর সমর্থক তথা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা  অজিত দোভাল ও মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা সুসান রাইসের মধ্যে। সেই টেলিফোনে বাৰ্তালাপের পরেই রণবীর সিংহ কিন্তু সাংবাদিক সম্মেলন করে এই সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের খবর দেন, যে স্ট্রাইকের সাথে আবার কিছুদিন আগে রিলায়েন্স ঘনিষ্ঠ কুইন্ট ওয়েব পোর্টালে প্রকাশিত ভারতের পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে হামলা করে ২০০ জঙ্গী মারার ভুঁয়ো খবরের অনেক মিল রয়েছে। সেই ভুঁয়ো স্ট্রাইকের কথা কিন্তু এই ভারতের সেনাবাহিনী কয়েক দিন আগেই নস্যাৎ করেছিল। কিন্তু সেই খবর যখন কুইন্ট প্রকাশ করে তখন চলছিল মোদীর সাথে সামরিক বাহিনীর কর্তাদের বৈঠক, হয়তো সেই বৈঠকের পূর্ব নির্দ্ধারিত স্বিদ্ধান্ত ছিল প্রচার মাধ্যম কে ব্যবহার করে যুদ্ধের জিগির জিইয়ে রেখে মোদীর স্বার্থ পূরণ করা। কিন্তু কোন সবুজ সঙ্কেত ছাড়াই যখন কুইন্ট বাড়িয়ে চড়িয়ে সেই ভক্তদের সাধের সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের খবর প্রকাশ করে তখন বেকায়দায় পড়ে যায় ভারতীয় শাসক শ্রেণী ও মোদী। পরের বারের আগে সাবধানে পা ফেলে নরেন্দ্র মোদী আর কর্পোরেট মিডিয়া সমস্ত পদক্ষেপ পরিকল্পনা অনুসারে নেয়। যতদূর জল গড়িয়েছে তাতে বিজেপি’র পিতৃপ্রতিম সংগঠন আরএসএস এর পুরানো মিত্র মুসলিম লীগ ও তার নেতা নওয়াজ শরীফের যোগও স্পষ্ট হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউস নির্দেশ অনুসারে হয়তো বিরিয়ানির পাতে পাতানো বন্ধুত্ব এই সংকট কালে কাজে এসেছে মোদীর। তাই তো যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার সময়ে আগেই বলে দেওয়া হচ্ছে যে পাকিস্তান সরকারকে ভারতের সামরিক আগ্রাসনের বিস্তারিত খবর দেওয়া হচ্ছে।

ভারতের সেনাবাহিনী যদি সত্যিই এই অভিযান করে থাকতো তাহলে মিলিটারির পক্ষ থেকে এমন তথ্য সাংবাদিক সম্মেলনেই প্রকাশ করা হতো যা দিয়ে পাকিস্তানের সেনার সমর্থনে বেড়ে চলা ইসলামিক সন্ত্রাসবাদীদের কার্যকলাপ কে দুনিয়ার সামনে খোলাখুলি দেখানো যেত। কিন্তু দেখানো হলো না, হয়তো সরকারের ফটোশপ মন্ত্রক তথ্য ও প্রমাণ অকাট্য রূপে সৃষ্টি করার কাজে জুটেছে। মনে পড়ে জেএনইউ কাণ্ডের ভিডিও? বা সম্বিৎ মহাপাত্রের মার্কিন সৈন্যের ঝান্ডা উত্তোলনের ছবিকে কারুকার্য করে ভারতীয় সেনার ঝান্ডা উত্তোলনের ছবি বানিয়ে জনতাকে দেশপ্রেমের টনিক খাওয়ানোর চেষ্টা?

ভারতের শাসক শ্রেণী ও তার সরকারি যন্ত্রের পক্ষে কোন রকমের জালিয়াতি অসম্ভব নয়। ভেজাল করে যে সরকারকে দেশপ্রেমের নামে উগ্র বিদ্বেষ ছড়িয়ে নিজের প্রতিপত্তি কায়েম করতে হয়, কাশ্মীরে প্রায় ৯০ জন মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে, ১০,০০০ স্বাধীনতা কামী জনগণ কে জখম আর পঙ্গু করে নিজেকে শক্তিশালী প্রমাণ করতে হয়, সেই সরকারের কোন কথায় শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন ও রাজনৈতিক ভাবে সচেতন মানুষের বিশ্বাস করা অসম্ভব।

উত্তর প্রদেশ নির্বাচনে এই সার্জিক্যাল স্ট্রাইক নামক ঘটনা কে মাইলেজ হিসেবে ব্যবহার করে ব্যাপক হারে ভোট কামানোর লক্ষ্যেই আরএসএস এর বেনারস শাখা ২৯শে সেপ্টেম্বর গঙ্গার ঘাটে সন্ধ্যা আরতিতে মোদী সরকারের বিজয়ের শঙ্খনাদ করে। বেনারস মোদীর নির্বাচন কেন্দ্র ও হিন্দু ধর্মের এক গুরুত্বপূর্ণ পীঠস্থান। এই জায়গায় হঠাৎ করে হিন্দুত্বের আবেগ জাগিয়ে তোলার ঘটনাও চোখে সন্দেহজনক ঠেকছে অনেকের। অন্যদিকে এই ঘটনার জেরে পাকিস্তানের মিডিয়ায় পাকিস্তানের সেনার হাতে ভারতের সৈনিকের গ্রেফতার হওয়া থেকে শুরু করে ভারতের বেশ কয়েকজন সৈনিক কে মেরে ফেলার খবর প্রকাশ হতে থাকে। ভারতের মিডিয়া আবার সেই সব খবর কে সরকারের কথা মতন নাকচ করে দেয় এবং ভারতের সৈন্যের জয় জয়কার করতে থাকে। আনন্দবাজার গোষ্ঠীর এবিপি চ্যানেল একটি টুইট করে জানান দেয় যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নাকি সারা রাত চোখের পাতা এক না করে জেগে বসে ছিল। এমনকি লোকটা নাকি সারা রাত্রি জল খায়নি ! এই কথাও প্রচার করছে এবিপি’র মতন তথাকথিত নিরপেক্ষ সংবাদ সংস্থা।  
 
ভারতের কর্পোরেট সংবাদ মাধ্যম ও সরকারি বামপন্থীরা এই সরকারের বিবৃতির মধ্যে লুকিয়ে থাকা স্ববিরোধ ও ফাঁকগুলোর কোনরকম সমালোচনা করার চেষ্টা করেনি। অথচ স্পষ্ট ভাবেই দেখা যাচ্ছে যে মোদী সরকার খুব চালাকির সাথে ভারতের উঁচু জাতের হিন্দুদের মধ্যে নিজের জনপ্রিয়তা টিকিয়ে রাখতে এই সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের উৎপত্তি করেছে। অথচ সাংবাদিকেরা কোন ভাবেই এই সহজ অঙ্কটা জনতার সামনে প্রকাশ করতে চাইছে না। কি এমন হলো যে সমস্ত সংবাদ সংস্থার চরিত্রটা সরকারি প্রচার মাধ্যমের মতন হয়ে গেল? কেন সরকারের দাবি প্রতিধ্বনি করাই সংবাদমাধ্যমের একমাত্র কাজ হয়ে উঠলো? কেন স্বাধীন ভাবে, সত্যের অনুসন্ধান করে জনগণের সামনে প্রকাশ করার কাজে এত অনীহা সাংবাদিকদের? কেন আমাদের দেশে স্বাধীন ও সাহসী সাংবাদিকতার এত অভাব?

ভারতের সংবাদ মাধ্যমগুলো নেহরু আমলেও শাসক শ্রেণীর চাটুকারিতা করতো, ইন্দিরার জমানায় কংগ্রেসের সামনে হামাগুড়ি দিত, সরকারের কথা পাঁচালীর মতন আউরে যেত। কিন্তু এমন কিছু সাহসী সাংবাদিক সেদিনও মূল ধারার সংবাদ মাধ্যমে ছিলেন যাঁরা কোনো ভাবেই ফ্যাসিবাদের সামনে মাথা নত করেননি, পেশার প্রতি, গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতি বিশ্বস্ত থেকে তাঁরা প্রশ্ন করেছিলেন স্বৈরতন্ত্র কে, পুলিশের হাতে মার খেয়েও, জেলের ভিতর বন্দি হয়েও, তাঁরা ঝোঁকেননি অন্যায়ের সামনে।  আজ সেই স্বাধীন ও নির্ভীক এবং গণতন্ত্রের প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সাংবাদিকদের বড় অভাব। আর তার সবচেয়ে বড় কারণ হলো নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতি। টিভি ও ইন্টারনেটে সংবাদ বিক্রি শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই পুঁজিপতিদের হাতে সংবাদ মাধ্যম সম্পূর্ণ কুক্ষিগত ছিল, সত্তরের বা আশির দশকেও ছিল, কিন্তু তাও সেই সময়ে প্রতিটি সংবাদ মাধ্যম কে পাঠকের কাছে নিজের কাগজ বিক্রির জন্য নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে এবং বিশ্বাসযোগ্য খবর ছাপতে হতো। কারণ কারুর পত্রিকা যদি সরকারের ঢাক পেটাতে থাকতো তাহলে পাঠকদের প্রতিযোগী গোষ্ঠীর কাগজের পাঠক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল প্রচুর। সেই নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত সাংবাদিকেরা খবরের পিছনে দৌড়তেন। কিন্তু কর্পোরেট সংস্থাগুলোর হাতে ধীরে ধীরে সংবাদের ব্যবসা কুক্ষিগত হওয়ার পর থেকেই সংবাদ সংগ্রহ করার চেয়ে বেশি জোর দেওয়া হলো সংবাদ সৃষ্টি করার, পাঠক বা দর্শকের চেয়ে বেশি জরুরী হলো টিআরপি যার দমে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ব্যাপক অর্থ আয় করা সম্ভব হয় টাইমস, জি, আনন্দ বা ফক্স গোষ্ঠীর। তাই দরকার হয় জানার যে বিজ্ঞাপন দাতারা কোন রাজনীতিটা আজ উর্দ্ধে তুলতে চায়, আজ্ঞাবাহক ভৃত্যের মতন তাই মিথ্যার চাদরে মনিবের নগ্ন দেহ ঢাকতে চায় কর্পোরেট সংবাদ মাধ্যম। মনে রাখতে হবে এই কর্পোরেট সংবাদ মাধ্যমের মূল কাজ হলো রাজনৈতিক জনমত তৈরি করে নিজেদের বিজ্ঞাপনদাতা ও লগ্নিকারী সংস্থাগুলোর স্বার্থ রক্ষা করা। তা বিজেপির দরবারে মুজরো করা অর্ণব গোস্বামীর টাইমস নাউ বা পাইওনিয়ার সংবাদপত্র হোক বা বিপ্লবী সাজা আনন্দ গোষ্ঠীর দি টেলিগ্রাফ অথবা এনডিটিভি হোক এদের সবাইকে মালিকের সামনে কুর্নিশ করতেই হবে। তাই যত বিপ্লবী বা সরকার বিরোধী কিছু কর্পোরেট সাংবাদিক সেজে থাক না কেন একদিন খোলাখুলি তাদের কাঞ্চন গুপ্ত বা স্বপন দাশগুপ্তের মতন হাটের মাঝে শাসকশ্রেণীর চাটুকারিতা করতেই হবে। আর এখানেই লুকিয়ে বিপদ।

যতদিন এই কর্পোরেট সংবাদ মাধ্যমের মিথ্যার গোলা কে ভাঙার স্বার্থে বিকল্প জনতার সংবাদ মাধ্যম তৈরি না করা যাবে, যতদিন না এই কর্পোরেট সংবাদ মাধ্যমের চাটুকারিতার বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত তৈরি করে এই মিথ্যার সওদাগরদের ভাতে মারা না যাবে, ততদিন আমাদের দেশের মানুষ কে যুদ্ধ ও হিংসার পক্ষে, জাতি ঘৃণা ও দমন পীড়নের পক্ষে টেনে আনার এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র চলতেই থাকবে। আজ সময় এসেছে মিথ্যার এই কারখানায়, ভেজাল জনমত তৈরির এই কারখানায়, বৃহৎ একচেটিয়া বিদেশী পুঁজির দালাল মিডিয়ার উপর জনগণের সংবাদ মাধ্যমের দ্বারা, মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের দ্বারা সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের। সার্জারি ছাড়া যে রোগী কে বাঁচানো যাবে না।

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে