উরির সেনা ছাউনিতে জঙ্গী হামলা ভারতের শাসক শ্রেণীর কাছে শাপে বর

মঙ্গলবার, সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৬ 0 Comments A+ a-

Attack on Uri camp is beneficial for Indian ruling classes


উরির সেনা ছাউনিতে জঙ্গী হামলার পর থেকেই সারা দেশজুড়ে আবার হিংস্র দেশপ্রেমের ফোয়ারা ছুটছে, উঁচু জাতের স্বচ্ছল মানুষের সমবেত ডাক হলো যে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে যাক ভারত সরকার। এমনকি সে যুদ্ধ যদি পারমাণবিক যুদ্ধ হয় তবুও যাক। বিজেপির মেজ-সেজ-ছোট সমস্ত শেয়ালরা এক রা ধরলো – যে করেই হোক পাকিস্তান কে শায়েস্তা করতে হবে । আর খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের দেশের কর্পোরেট মিডিয়াগুলো এই “রক্ত চাই, রক্ত চাই” স্লোগানে গলা মেলালো, পাকিস্তানের উপর বোমা বর্ষণ করার থেকে শুরু করে মার্কিন কায়দায় পাকিস্তানের  ভিতরে ঢুকে তথাকথিত সার্জিকাল স্ট্রাইক চালাবার উপদেশও দিল অনেক বড় বড় সামরিক ও সুরক্ষা বিষয়ে পান্ডিত্য অর্জন করা টেলিভিশন সেলিব্রিটিগণ । কাশ্মীর প্রসঙ্গে দেশে ও বাইরে মুখ পুড়িয়ে মোদী সরকার যেন ঠিক এই রকমই একটা ঘটনার অপেক্ষায় ছিল, যে ঘটনা কে ব্যবহার করে দেশের উঁচু জাতের হিন্দুদের মধ্যে উগ্র দেশপ্রেম কে পিনের খোঁচায় জাগানো যায়, আর যেহেতু বর্তমান ভারতবর্ষে দেশপ্রেম মানেই হলো পাকিস্তানের প্রতি অতিশয় ঘৃণা তাই এই আবহাওয়াকে ব্যবহার করে নিজের সকল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যর্থতা থেকে জনতার দৃষ্টি ঘোরাতে সচেষ্ট হলো মোদী সরকার । এটা রাজনৈতিক মহলে সকলের জানা যে মার্কিন একচেটিয়া পুঁজির সমর্থন ছাড়া ভারত বা পাকিস্তানের সরকার বা শাসকশ্রেণী এক পাও আগে চলতে পারবে না, বিশেষ করে আজকের পরিস্থিতিতে যদি মার্কিন সমর্থন না থাকে তাহলে তো মোদী হোক বা নওয়াজ শরিফ, মুখ তো কেউই খুলবেই না, হাত পা চালানো দূর অস্ত। তাই মেপে মেপে মোদী সরকার নানা সময়ে বাজানো  সেই পাকিস্তান ও সন্ত্রাসবাদের ফাটা রেকর্ড কে আঠা দিয়ে জুড়ে আবার বাজালো - পাকিস্তান কে আন্তর্জাতিক মহলে এক ঘরে করে দেওয়া হবে, পাকিস্তান কে একটি সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র ঘোষনা করা হবে, ইত্যাদী সব পরিচিত হুমকি আবার শোনালো। এখনই যুদ্ধে যাওয়ার মার্কিন সবুজ সংকেত আসেনি সে কথা স্পষ্ট করে বোঝা গেল। আর বোঝা গেল যে তলে তলে বিরিয়ানির পাতের বন্ধুত্ব কে নওয়াজ আর নরেন্দ্র সেই অটল বিহারী বাজপেয়ীর জমানার মতন করেই গড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে । মনে পড়ে ১৯৯৯ সালে সেই ঘরে বাইরে ভয়ানক মূল্য বৃদ্ধির মধ্যে ভারতবর্ষে কয়েক ভোটে অনাস্থা প্রস্তাব হেরে যাওয়া অটল বিহারীর বিজেপি সরকারের যখন কোনো ভাবেই ভোটে জিতে ফিরে আসা সম্ভব ছিল না ঠিক সেই সময়ে নিজের লস্কর বাহিনী পাঠিয়ে একটা যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা খেলে আর পাঁচ শত ভারতীয় সেনা কে গুলি মেরে ওই সংঘ পরিবারের পুরানো বন্ধু - মুসলিম লীগের নওয়াজ সাহেব আবার অটল বিহারীকে ভোটে জেতার সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছিল ? সেই অটল-নওয়াজ পিরীতের মতনই এবার নওয়াজ-নরেন্দ্র পিরীত এগিয়ে চলেছে এক সুন্দর মধুচন্দ্রিমার দিকে, যেখানে লক্ষ হলো একে অপরের স্বার্থে, মিলে মিশে মার্কিন আদেশ অনুসারে কাজ করা ।
ভারতবর্ষে যখনই কোন না কোন জঙ্গী হামলা হয় বা সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ হয় তখনই হঠাৎ কোনো তথ্য বা প্রমাণের অভাব সত্বেও আমাদের কর্পোরেট মিডিয়া সরাসরি সরকারি ভাষা ও প্রেস বিজ্ঞপ্তির প্রতিধ্বনি শোনায়। সরকারের বয়ান কে একেবারে বৈদিক সত্য মেনে নিয়ে সেই বক্তব্য কে বার বার নানা কায়দায় প্রচার করে মানুষের মধ্যে সরকারের বক্তব্যকে, শাসক শ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গী কে সুদৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠা করাই আজ মূল ধারার সংবাদ মাধ্যমের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো মিডিয়া গোষ্ঠী এই প্রশ্নটা তুললো না যে বারামুল্লা জেলার সীমান্তের নিকটে উরির সামরিক ছাউনিতে যে চার জন জঙ্গী হামলা করে ১৭ জন সৈনিক কে মারলো তাঁরা পাকিস্তানি না আফগান না কাশ্মীরি সে কথা লড়াই চলাকালীন সময়ে কি ভাবে ভারত সরকার বা দেশের শাসক গোষ্ঠী আর সমস্ত সংসদীয় রাজনৈতিক দলের নেতারা জানতে পারলো? কোনো সংবাদ মাধ্যমের চাকুরে সাংবাদিকেরা প্রশ্ন তুললেন না যে পাকিস্তান কে দোষ দেওয়ার পিছনে কি সত্যিই কোনো বস্তুগত প্রমাণ বা নথি রয়েছে? জঙ্গীরা কাশ্মীরেরই বিক্ষুব্ধ যুবক নন সে কথা এতো শীঘ্র দেশের সেনা বাহিনী ও মোদী সরকার কি করে জানতে পারলো ? পাকিস্তান যদি কাউকে ভারতের সেনা ছাউনিতে আক্রমণ করতে পাঠায় তাহলে তাদের অস্ত্র ও মালপত্রে নিজের দেশের সিলমোহর মেরে দুনিয়া কে কেন জানান দিতে যাবে যে এই জঙ্গীরা পাকিস্তানের পোষ্য? কোনো দেশের পেশাদার গোয়েন্দা সংস্থা তো দূরের কথা আমাদের কলকাতার পকেটমারদের দলও কোথাও নিজের অপরাধে কোন এমন সূত্র ছেড়ে আসবে না যার মাধ্যমে পুলিশ ওদের নামে কেস দিতে সক্ষম হয়।ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র’ পাকিস্তানের যে সব জঙ্গীদল কে সমর্থন করে তাদের হাতে কি অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি বোর্ডের ছাপ মারা রাইফেল তুলে দেয়?    
ভারত সরকারের মতনই এই দেশের কর্পোরেট সংবাদ সংস্থাগুলোর একটি অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে বিনা তথ্য ও প্রমাণ নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর বিরুদ্ধে জনমানসে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে উগ্র দেশপ্রেমের জোয়ার সৃষ্টি করা। আর যেহেতু সমালোচনায় নিস্পৃহ ভারতের উচ্চ জাতের লোকেরা নিঃশর্ত বিশ্বাস নিয়ে ভারতের কর্পোরেট মিডিয়ার প্রচারে বিশ্বাস করে, সরকার আর তার ঘুষখোর দুর্নীতিবাজ অফিসারদের বয়ান কে ঘোর সত্য বলে মনে করে, তাই তারা যে এই প্রচারের সততা নিয়ে কোনোদিন প্রশ্ন তুলবে না তা বলা বাহুল্য।

উরি সেনা ছাউনির উপর আক্রমণের কয়েক মাস আগে, ঠিক ২০১৬ সালের শুরুর দিকে পাঞ্জাবের পাঠানকোটের বায়ু সেনার ঘাঁটিতে হঠাৎ হামলা চালায় কিছু জঙ্গী। হামলা চলাকালীন আমাদের সবজান্তা সংবাদ মাধ্যমগুলো ঘোষণা করে দিলে যে এই কাজ পাকিস্তান থেকে আসা কিছু জঙ্গীর কাজ।  জঙ্গীরা নাকি মোদী সরকারের উপর ভীষণ ক্ষিপ্ত আর তাই ওরা পাঠানকোটে হামলা করে। সুক্ষ ভাবে মিডিয়া বোঝাতে চেয়েছিল এই দেশের অভিজাত ব্রাক্ষণত্ববাদীদের যে মোদী সরকারের উপর যে বা যারা ক্ষিপ্ত তাঁরা এই জঙ্গীদের মতনই “দেশ-বিরোধী শক্তি”। রীতিমত এই পাকিস্তান আর আইএসআই এর যুক্ত থাকার অভিযোগের গুলি আমাদের জলে গুলে জোর করে গেলানো হয়েছিল প্রতিবারের মতন। ঠিক যেমন বালুচিস্তানে কোন হামলা হলে পাকিস্তানের সরকার আর কর্পোরেট মিডিয়া তার পিছনে ভারতীয় হাত খোঁজে ঠিক তেমনি করে ভারতীয় উচ্চ জাতের হিন্দুদের মধ্যে, অভিজাত শহরবাসী পলিসি মেকারদের বার বার করে পাকিস্তানের হাত খুঁজতে বলা হয় প্রতিটি ঘটনায়। চোখের সামনে বৃহৎ করে দেখানো হয় ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যেকার দ্বন্ধ কে আর সাথে সাথে খুবই ধূর্ততার সাথে পাকিস্তান বিরোধিতার সুরটা  মুসলমান বিরোধী সুর হয়ে যায় আর আদিত্যনাথ বা সাক্ষী মহারাজদের গলার পারদ চড়ে যায়, পাকিস্তানের শাসক শ্রেণী চলে যায় অন্তরালে আর আক্রমণের লক্ষ্য বস্তু হয় ছা পোষা খেটে খাওয়া সাধারণ মুসলমান জনগণ।এই ভাবেই রাষ্ট্র যন্ত্রের সরাসরি প্ররোচনায় সৃষ্টি হয় অসংখ্য  গুজরাটের, মুজ্জাফরনগরের, দাদরির, মেওয়াতের, বা বিজনোরের।হিন্দুত্ববাদের ত্রিশূলের আঘাতে প্রাণ যায় গরিব মুসলমানের আর মসনদের গদির চামড়া নিয়ে কামড়া কামড়ি করতে থাকা নরেন্দ্র মোদী বা রাহুল গান্ধীরা এই হত্যালীলার তপ্ত উনুনে নিজেদের ভোগের খিচুড়ি  রান্না করে। ভারতের সংবাদ মাধ্যমের একটা অংশকে  কে যদিও বিজেপি ও আরএসএস এর নেতারা বৈশ্যা বলে ডাকলেও শেষ দৃষ্টিতে দেখতে গেলে ব্রাক্ষণত্ববাদী সংবাদ মাধ্যম কিন্তু নানা ছল-কপট-কায়দার সাহায্যে হিন্দুত্ববাদী শক্তিরই সাহায্য করে থাকে।          

ভারতের শাসক শ্রেণীর বা ওদের প্রতিনিধি সরকারের কোনো সর্বাঙ্গীণ জাতীয় সুরক্ষা নীতি নেই। এই নীতি না থাকার পিছনে রয়েছে ভারতের শাসক শ্রেণীর অভ্যন্তরীণ দ্বন্ধ ও সারা বিশ্বে মার্কিন আধিপত্য কায়েমের রণনীতি। যে সুরক্ষা নীতিকে আজ আঁকড়ে ধরে মোদী থেকে অজিত দোভাল সকলেই দেশপ্রেম আর জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষার কথা বলছে সেই নীতি ভারতের স্বার্থে ভারতে রচিত নয়, বরং সুদূর মার্কিন মুলুকের পেন্টাগনের পন্ডিতেরা বসে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগী শক্তির স্বার্থ রক্ষার জন্যে ভারতের জাতীয় সুরক্ষা নীতির রচনা করেছে বিগত দেড় দশক ধরে। এই নীতির মূল কাজ হলো সামরিক ভাবে চীন কে টেক্কা দেওয়া আর যে করেই হোক দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার রণাঙ্গনে মার্কিন স্বার্থ বিরোধী শক্তি কে বিনাশ করতে ভারতীয় সামরিক শক্তিকে ব্যবহার করা। গুরগাঁও বা বেঙ্গালুরু শহরে আউটসোর্সিং এর কাজ শুরু হওয়ার ঢের আগে থেকেই কিন্তু মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ আর মার্কিন ফৌজ নিজেদের কাজকর্ম ভারতের মতন নয়া ঔপনিবেশিক দেশগুলোর সরকারকে আউটসোর্স করেছিল। আজ ভারতের শাসক শ্রেণী মার্কিন-ইজরাইলি জোটের সাথে হাত মিলিয়েছে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় নিজের আধিপত্য কায়েম করতে, এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক, খনিজ, ও সামুদ্রিক সম্পদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগী শক্তিগুলো কে লুঠ করতে সাহায্য করাও ভারতের শাসক শ্রেণীর কমিশন কামানোর একটা গুরুত্বপূর্ণ পথ। মার্কিন সেনাকে ভারতের জমি, জল, ও বায়ু পথ ব্যবহার করার যথেচ্ছ ছাড়পত্র দিতে মোদী সরকার এলইএমওএ, বা লজিস্টিক্স এক্সচেঞ্জ মেমোরেন্ডাম অফ এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষর করেছে এবং বেশ কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এই চুক্তি কার্যকর করা শুরু হবে। এই চুক্তির মাধ্যমে বকলমে ভারত মার্কিন সেনার ঘাঁটি হয়ে উঠবে এবং মধ্য প্রাচ্যে চলা মার্কিন সৈন্য অভিযানে টাকার বিনিময়ে নানা প্রকারের পরিষেবা প্রদান করবে।  

ভারতের বিশাল বাজার, বিশাল খনিজ সম্পদ, সস্তা শ্রম ও নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির গড্ডালিকায় গা ভাসানো সরকারি নীতির ফলে ভারত মার্কিন পুঁজির ও মার্কিন সরকারের কাছে পাকিস্তানের চেয়ে বেশি প্রিয়। ফলে ১২৩ পারমাণবিক চুক্তি, মার্কিন-ভারত সৈন্য চুক্তি, এলইএমওএ, ইত্যাদি বন্ধনে ভারতকে বাঁধতে বেশি উদগ্রীব ওয়াশিংটন ডিসি ও পেন্টাগন। এর ফলে ভারতের শাসক শ্রেণী মার্কিন পুঁজির শ্রেষ্ঠ দালাল হিসেবে উঠে আসায়, সাত দশক ধরে মার্কিন দালালি করা পাকিস্তানের শাসক শ্রেণীরও গায়ে জ্বালা ধরছে। এ যেন বৈশালয়ে চেনা খদ্দেরের অন্য ঘরে চলে যাবার মতন ব্যাপার।তাই পাকিস্তানের শাসক শ্রেণীও চাইছে যে ভারতের শাসক শ্রেণীর মতন তাদেরও কোলে দোল খাওয়াক মার্কিন বাবারা।  কিন্তু সমস্যা হলো ওই মার্কিন নির্দেশে ১৯৮০’র দশকে যে ইসলামিক মৌলবাদের পথ ধরেছিল পাকিস্তান বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক শক্তির কন্ঠরোধ করতে, সেই মৌলবাদ আজ পাকিস্তানের অভ্যন্তরে এমন আগুন লাগিয়েছে যে পাকিস্তানের বাজার আর নয়া উদারনৈতিক বাণিজ্য বা কাঁচা মাল লুঠ করার জন্যে খুব একটা সুরক্ষিত নয়। তাই তো তালিবানের হাতে গুলি খাওয়া মালালা ইউসুফজাই সারা বিশ্বে নারী ও শিশুর অধিকারের লড়াইয়ের চেহারা হয় আর কাঁচা মাল ও খনিজ সম্পদ লুঠের স্বর্গ রাজ্য ভারতের বুকে অসংখ্য সুরেখা ভোতমাঙ্গে তাঁর কন্যা প্রিয়াঙ্কা ভোতমাঙ্গে সহ ধর্ষিত আর খুন হন আর কোনো আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাঁর নাম ওঠে না, কোনো কর্পোরেট সংস্থা মহারাষ্ট্র থেকে দলিত নিপীড়ন মোছার অঙ্গীকার করে না, কেউ মোমবাতি নিয়ে সুরেখা ভোতমাঙ্গের জন্যে মিছিল করে না, সুরেখা-প্রিয়াঙ্কার জন্যে কেউ ন্যায় চায় না। আফস্পা যেমন সৈন্য বাহিনীকে বেপরোয়া হয়ে খুন ধর্ষণ করার অধিকার দেয় ঠিক তেমনি ব্রাক্ষণত্ববাদ সাবর্ণ সমাজ কে দলিত-আদিবাসী-মুসলমান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের হত্যা ও ধর্ষণ করার অবাধ অধিকার দিয়েছে।    

ভারতের সাথে পাকিস্তানের দ্বন্ধ যে কাশ্মীর নিয়ে চলছে সেই কাশ্মীরের মানুষের উপর আরও বেশি করে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করতে, আরও বেশি করে কাশ্মীরের নিরীহ জনতা কে গুলি আর ছররা মেরে হত্যা করতে, আরও বেশি করে মানসিক ভাবে কাশ্মীরিদের ভারতীয় শাসক শ্রেণীর সামনে হীন মনস্ক করে তুলতে, উরি আর পাঠানকোটের মতন হামলা ভারতের শাসক শ্রেণী কে সাহায্য করে। যখন দেশ জোড়া আন্দোলনের ফলে পোটার মতন জনবিরোধী কালা কানুন কে ভারতের শাসক শ্রেণী বাধ্য হয়ে ফিরিয়ে নেয় ঠিক তখনই কোথাও না কোথাও সন্ত্রাসবাদী হামলা হয় আর সেই ঘটনা ও ব্যাপক হারে মানুষের মৃত্যুর ঘটনা কে ব্যবহার করে ভারতের শাসক শ্রেণী আবার নতুন কালা কানুন বানিয়ে জনতার অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। তাই কাশ্মীরি জনতার উপর বর্বর হামলা করার পরে গোটা দেশ ও বিশ্বে ব্যাকফুটে পৌঁছে যাওয়া ভারত সরকারের কাছে অবশ্য কর্তব্য হয়ে উঠেছিল নিজের পক্ষে পরিস্থিতি কে শক্ত করে তোলা আর সেই কাজে খুব নিপুন ভাবে কাজে লাগলো উরি সেনা ছাউনির উপর আক্রমণ। এই আক্রমণ আইএসআই করিয়েছে না ভারতের গুপ্তচর সংস্থা র’ নিজেই করিয়েছে সে প্রশ্ন অবান্তর, কারণ এখানে মূল বিষয় হলো যে এই আক্রমণের ফলে কোন শক্তির উপকার হলো। একটু গভীরে ঢুকলেই দেখা যাবে যে এই ঘটনার পরে পাকিস্তানের চেয়ে বেশি লাভজনক পরিস্থিতিতে রয়েছে ভারতের শাসক শ্রেণী আর তার প্রতিনিধিদের সর্দার নরেন্দ্র মোদী।

এই মোদীর খাস লোক আর সংঘ পরিবারের কাশ্মীর বিষয়ক পন্ডিত রাম মাধব এই কিছুদিন আগেই আরএসএস এর সংস্থা ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন ও মুৎসুদ্দি বেনিয়াদের সংগঠন ফিকির যৌথ উদ্যোগে জাতীয় সুরক্ষার উপর একটা অধিবেশনে ভাষণ দিতে গিয়েছিল। সেখানে রাম মাধব বলেছিলো যে যেহেতু ভারতীয়রা (আরএসএস এর অভিধান হিসেবে পড়ুন হিন্দুরা) ভীষণ সহিষ্ণু ও উদার তাই চীনের রাজারা চীনের সুরক্ষার জন্যে প্রাচীর গড়লেও ভারতীয় শাসকেরা কোনোদিন খাইবার পাসের কাছে পর্বতের পথে কোনো বাঁধ তৈরি করেননি। রাম মাধব আরও বলেছিল যে ভারতের উচিত একটি এমন সুরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করা যা জাতীয় শত্রুদের নিমেষে নিকেশ করে দেওয়ার পথ প্রশস্ত করবে। এই কথা বলে রাম মাধব আবার কায়দা করে সেই বস্তা পঁচা বহিরাগত মুসলমানদের তত্ব কে হাজির করার চেষ্টা করেছিল, যে তত্ব কে ভাঙ্গিয়ে আর উঁচু জাতের হিন্দুদের মধ্যে লালিত পালিত মুসলমান বিরোধী বিদ্বেষ কে কাজে লাগিয়ে আজ সারা ভারতে আরএসএস প্রসারিত হচ্ছে।রাম মাধবের বক্তব্যের উপর চোখ বোলালে বোঝা যায় যে আরএসএস এই মুহূর্তে কাশ্মীরের উপর সামরিক শাসনের বেড়িকে আরও কষে বাঁধতে চায় এবং এই কাজের জন্যে ভারতের মধ্যে সরকার বিরোধী, মোদী বিরোধী, ও ভারতের সম্প্রসারণবাদী নীতি বিরোধী শক্তিগুলোকে চিরতরে চুপ করানো একান্তই প্রয়োজন। আর এই ব্যাপক হারে বিরোধীদের (সংসদীয় নয়) চুপ করাবার কাজে সাহায্য করতে পারে সন্ত্রাসবাদের ভূত, যা ভারতের সরকার মার্কিন দেশ থেকে সেই অটল বিহারি আর লাল কৃষ্ণ আডবানির যুগে শিখেছিল।  

সন্ত্রাসবাদের জুজু দেখিয়ে ভারতের শাসকশ্রেণী মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তদের নিজের কব্জায় রাখতে পারে। এর অন্যতম কারণ হলো যে দেশের শহুরে মধ্যবিত্তদের সিংহভাগ হলো উঁচু জাতের হিন্দু, যাদের মধ্যে জাতি ঘৃণা ও সাম্প্রদায়িক ঘৃণা প্রবল এবং মূলতঃ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার ফেলে যাওয়া শিক্ষা ব্যবস্থায় লেখাপড়া শেখার কারণে এদের দ্বান্ধিক ভাবে বস্তুর বিচার বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা নেই। ফলে এই শ্রেণীর সিংহভাগ লোকই চিরকাল নিজেদের বিশ্বাস কে চিরন্তন সত্য হিসেবে গণ্য করে এবং এই ভাবে শাসক শ্রেণীর নীতির প্রতি ধীরে ধীরে আনুগত্য দেখায়, ততদিন দেখায় যতদিন না সেই নীতিগুলি এদের পেটে লাথি না মারে। মুসলমানদের প্রতি যে অবিশ্বাস ও ঘৃণা এবং দলিত ও আদিবাসীদের তুলনায় জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের যে চেতনা সাবর্ণ হিন্দুদের মধ্যে শৈশব থেকে ঢোকানো হয় তার ফলে  ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ সংক্রান্ত যে সব আষাঢ়ে গল্প ভারতের ব্রাক্ষণত্ববাদী শাসকশ্রেণী শোনায়, তাতে নিঃশর্ত বিশ্বাস করা শুরু করে এই স্বচ্ছল শ্রেণী। মধ্যবিত্তদের রাজনৈতিক চেতনা যেহেতু শ্রমিক ও খেটে খাওয়া জনগণকে চরম ভাবে প্রভাবিত করে তাই এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে রাজনৈতিক ভাবে নিজের দিকে টেনে আনলেই ব্রাক্ষণত্ববাদী শাসকশ্রেণীর পক্ষে এক ঢিলে দুই পাখি মারা সম্ভব হয়ে যায়। তখন উরি হামলার মতন ঘটনা কে ব্যবহার করে, মন্ত্রী, ডিজিএমও, মিডিয়া প্রভৃতি ব্যবহার করে ভারতের শাসকশ্রেণী শুধুই মধ্যবিত্তদের নয় বরং শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি জনতাকেও উগ্র দেশপ্রেমের নামে ক্ষেপিয়ে তুলতে সক্ষম হয়।

আধুনিক কালে আবিষ্কৃত সন্ত্রাসবাদ চিরকালই শাসকশ্রেণীকে মদত করে নিজ অভীষ্ট লক্ষকে ঘুরিয়ে অর্জন করতে। ভারতের শাসকশ্রেণী মার্কিন শাসক শ্রেণীর মতন চতুরতার সাথে সন্ত্রাসবাদের জুজু দেখিয়ে ভারতের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট থেকে জনগণের দৃষ্টি এক অদৃশ্য সন্ত্রাসবাদী শক্তির দিকে ঘুরিয়ে রাখে।কেউ দেখেনি, কেউ চেনেনি এমন এক একটি কাল্পনিক দল কে শাসক শ্রেণীর গোয়েন্দা দফতর দেশের শত্রু, হিন্দু সাবর্ণ সমাজের শত্রু, দেশের তথাকথিত অখণ্ডতার শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে এবং নিজেদের তত্বকে ওজনদার করতে মাঝে মধ্যেই বেশ কিছু মুসলমান যুবক ও যুবতীদের ধরে জেলে ঢোকায় সন্ত্রাসবাদী হিসেবে। ব্রাক্ষণত্ববাদী উচ্চ জাতির হিন্দুরা তখন আতঙ্কগ্রস্ত হয়, তারা বিশ্বাস করে যে সত্যিই ভারতবর্ষ কোনো ইসলামিক জঙ্গী গোষ্ঠীর নিশানায়, সত্যিই পুলিশ আর গোয়েন্দারা একেবারে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের মতন সদা সত্যি কথা বলে। যদিও অশ্বথামা হত’র পরে ইতি গজ কোনোদিন আমাদের ব্রাক্ষণত্ববাদী উচ্চ জাতির লোকেরা শুনতে পায়না অথবা শুনতে চায় না। যখন ১১ বা ১২ বছর সন্ত্রাসবাদে জড়িত থাকার অভিযোগে একজন মুসলমান জেল খাটার পরে বেকসুর হয়ে ছাড়া পায় তখন সেই গোয়েন্দা আর পুলিশের নিন্দা কেউ করে না, তখন একটা মানুষের জীবনের অনেকগুলো অমূল্য দিন, তার যৌবন, তার স্বপ্ন কে ধ্বংস করার জন্যে  সেই সরকারের কাছে কেউ ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারে না যে সরকার বিনা প্রমাণে নিরীহ লোকেদের শুধুমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে গ্রেফতার করে জেলে বন্দি করছে।জাতীয় সুরক্ষা লঙ্ঘন করা হবে যে ! বেঙ্গালুরু শহরে ১৬ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসবাদে যুক্ত থাকার অভিযোগে ২০১২ থেকে জেলে বন্দি ১৩ জন মুসলমান যুবকেরা জজ সাহেবের সামনে এই জন্যে নিজেদের দোষী হিসেবে স্বীকার করে নেয় যে এর ফলে তাঁদের আর মাত্র এক বছর জেল খাটতে হবে কারণ আইন অনুযায়ী শাস্তি হবে পাঁচ বছর যার মধ্যে চার বছর তাদের জেল খাটা হয়ে গেছে। তাঁরা জানতেন যে যদি তাঁরা দোষ স্বীকার করে না নেন তাহলে ভারতের আইন ব্যবস্থায় হয়তো তাঁদের দুই দশকের বেশি সময় ধরে জেলে থাকতে হবে, কারণ তাঁরা যে মুসলমান।

উরির সেনা ছাউনিতে জঙ্গী হানার ঘটনা কে কেন্দ্র করে এখন আবার দেশ জুড়ে সংঘ পরিবার হিন্দু সাবর্ণ ও দলিতদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে মেরুকরণের মাধ্যমে নিজেদের শিবিরে টেনে আনতে চাইবে এবং উগ্র দেশপ্রেমের নামে হিংসাত্মক প্ররোচনা দেবে এবং সব চেয়ে বেশি চেষ্টা করবে কাশ্মীরের জনগণের উপর নৃশংস দমন পীড়নের পক্ষে ব্রাক্ষণত্ববাদী সাবর্ণদের সমর্থন কে সুনিশ্চিত করার। যাতে আগামী দিনে আরও বেশি করে কাশ্মীরি জনতা কে হত্যা করা যায়, পেলেট ছুড়ে অন্ধ করা যায় আর দেশের নানা প্রান্তে যে সমস্ত বিপ্লবী ও গণতান্ত্রিক শক্তি এই নৃশংস দমন পীড়ন ও সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন তাঁদের বিরুদ্ধে উচ্চ জাতির হিন্দুদের ক্ষেপিয়ে তুলে পুলিশি দমন পীড়ন নামিয়ে আনা যায়। আমরা যে জরুরী অবস্থার মধ্যে বাস করছি, বকলমে একটি ফ্যাসিস্ট পুলিশ রাষ্ট্রে বাস করছি সেই সত্যটা এই রাষ্ট্র যন্ত্র ও তার শাসক শ্রেণী আমাদের প্রতিদিন জানান দেবে। যদি এই অপপ্রচার, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ, জাতি বিদ্বেষ, মুসলমান সহ সংখ্যালঘুদের প্রতি তীব্র ঘৃণার প্রসারণ, ইত্যাদীর আড়ালে দেশের জনগণকে মার্কিন সেনার কামানের খোরাক বানানোর, দেশের খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ কে লুঠ করতে দেওয়ার যে ষড়যন্ত্র ভারতের ব্রাক্ষণত্ববাদী শাসক শ্রেণী ও তাদের প্রতিনিধি আরএসএস ও বিজেপির নেতৃত্বে চলা ফ্যাসিবাদী নরেন্দ্র মোদীর সরকার চালাচ্ছে তার বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে গরিব কৃষক, শ্রমিক, দলিত, আদিবাসী ও সংখ্যালঘু সমাজ কে ঐক্যবদ্ধ করে যদি এক ব্যাপক গণ ফ্রন্ট, যুক্ত ফ্রন্ট না গড়া যায়, তাহলে খুব তাড়াতাড়ি এই উগ্র স্বদেশ প্রেমের নামে ভারত সরকার এক যুদ্ধে সামিল হবে মার্কিন পুঁজির স্বার্থে ও তার খরচের বোঝা এই দেশের গরিব মানুষের কাঁধে চাপবে। স্বদেশ কে রক্ষা করতে আজ আমাদের দেশের সকল শোষিত, নিপীড়িত ও দেশপ্রেমী শক্তিকে লড়তে হবে ব্রাক্ষণত্ববাদী সামন্ত প্রভু, দালাল পুঁজিপতি ও বিদেশী পুঁজির পা চাটা দালাল সংঘ পরিবারের সাবর্ণ ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে, এক নতুন গণতান্ত্রিক ও শোষণ মুক্ত ভারতবর্ষ গড়ার লক্ষ্যে।লড়াই ছাড়া, সংগ্রাম ছাড়া আজ দেশের শোষিত ও অত্যাচারিত জনতার সামনে আর কোনো রাস্তা নেই নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকার কে সুরক্ষিত করার ও এক ধর্ম নিরপেক্ষ ব্যবস্থা গড়ে তোলার। তাই আপনি যদি গণতন্ত্রের পক্ষে হন, আপনি যদি ধর্ম নিরপেক্ষতার পক্ষে হন, আপনি যদি গরিব মানুষের প্রগতি ও আর্থিক উন্নয়নের পক্ষে হন, আপনি যদি স্বদেশের সমৃদ্ধির পক্ষে হন তাহলে আজ আপনাকে এই বৃহত্তর ফ্যাসি বিরোধী সংগ্রামে যোগ দিতেই হবে। কারণ মানব ইতিহাস সত্যিই আমাদের কোনো সহজ বিজয়ের পথ দেখায়নি।       

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে