২০১৬ কালিয়াচকের দাঙ্গার ঘটনার একটি বস্তুগত বিশ্লেষণ

শুক্রবার, জানুয়ারী ০৮, ২০১৬ 0 Comments A+ a-

মালদার কালিয়াচকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে বলে একটি দেশজোড়া প্রচার চলছে। রবিবার ৩রা জানুয়ারীর অশান্তির খবর পাওয়ার পরে আমরা আমাদের ইংরাজি প্রকাশনীর পক্ষ থেকে সংবাদ সংগ্রহ করতে কালিয়াচকে যাই মঙ্গলবার ৫ই জানুয়ারী রাতে এবং বুধবার ৬ই জানুয়ারী অবধি তদন্ত করে যে রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে তা পিপলস রিভিউ তে আগামী রবিবার ছাপা হবে।  তার আগে আমাদের রিপোর্ট এর থেকে কালিয়াচকের ঘটনার রূপরেখা পাঠকের স্বার্থে এখানে প্রকাশ করছি:

কালিয়াচকের ঘটনা আসলে কি  - সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা না হিংসাত্মক ঘটনা ?


আঞ্জুমান আহলে সুন্নাতুল জামাত নামক একটি সুন্নি সংগঠন গত রবিবারে একটি প্রতিবাদ মিছিলের ডাক দেয় গত ডিসেম্বর মাসের শুরুতে উগ্রপন্থী হিন্দু নেতা কমলেশ তিওয়ারির মুসলমানদের ধর্মগুরু মুহাম্মদের উপর করা কটুক্তির বিরোধিতা করে। মিছিলে যোগ দেওয়ার কোনো প্রকাশ্য প্রচার এলাকার মানুষ মনে করতে না পারলেও বেশ কিছু পোস্টার লাগানো হয়েছিল। মূলত দক্ষিন মালদার সংখ্যালঘু অধ্যুষিত সুজাপুর বিধানসভা কেন্দ্রের মসজিদ চত্বরগুলিতে কিছু ছেঁড়া পোস্টার আজও চোখে পড়তে পারে।  এই মিছিলে অংশগ্রহণ করেন প্রায় ৩০,০০০ থেকে ৩৫, ০০০ লোক, যে সংখ্যাটি হিন্দি ও ইংরাজি কর্পোরেট মিডিয়া দুই থেকে আড়াই লক্ষ মানুষের মিছিল বলে প্রচার করে সারা দেশে এবং আরএসএস সংখ্যাটিকে আড়াই লক্ষে ধরে রেখেছে এখনো।

মিছিল জাতীয় সড়ক ধরে যখন চলতে থাকে তখন আসে পাশের গাড়ি, বাস ও লরি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয় এবং মিছিল মিটিং এর রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে এ কোনও নতুন কান্ড নয়। কিন্তু ঝামেলা শুরু হয় যখন বিএসএফের একটি জিপ রাস্তা থেকে সরে যেতে অস্বীকার করে এবং কথা কাটাকাটির মধ্যে মিছিল কারীদের ভয় দেখাতে বিএসএফ জওয়ানরা বন্দুক তাক করে, এর ফলে অশান্তি তীব্র মাত্রায় বেড়ে যায় বিএসএফ জওয়ানরা মিছিলকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে শুন্যে গুলি চালায় এবং এর ফলে ছোটাছুটি শুরু হয়ে যায়, এর মধ্যে একটি যাত্রী বোঝাই বাস মিছিলের মধ্যে দিয়ে পার হতে যায় এবং সেই বাসের ড্রাইভারের সাথে ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়ে অনেক মিছিলকারী, বাস খালি করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় বাসে, অন্যদিকে বিএসএফের জওয়ানদের তাড়া করে জিপে আগুন জ্বালিয়ে দেয় কয়েক জন। এই সময়ে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা লরি ও বাসে ঢিল ছোড়া শুরু হয় এবং তার মধ্যেই কালিয়াচক থানার পুলিশ পৌঁছে শুন্যে গুলি চালানো শুরু করে।
পুলিশের গুলি চালানোর পরেই ভিড় ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং তুমুল বিশৃঙ্খলা শুরু হয়, বহু মানুষ দৌড়ে পালাতে থাকেন অনেকে পরে আবার দল নিয়ে ফিরে আসে আর থানায় আক্রমণ করে প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার লোক। থানার নথিপত্র ও আসবাবপত্রে আগুন লাগানো হয়। এর মধ্যে পুলিশ আবার শুন্যে গুলি চালায় এবং আক্রমণকারীদের প্রতিহত করে। কিছুক্ষণ পরেই চলে আসে আরএএফ এর গাড়ি এবং অবস্থা নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। কালিয়াচকে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।

এই সমস্ত ঘটনার সময়ে কোনো হিন্দু বাড়িতে আগুন লাগানো, লুঠপাট, হিন্দু মহিলাদের ধর্ষন বা শ্লীলতাহানির কোনও ঘটনা ঘটেনি।

কালিয়াচকের হাঙ্গামার নৈপথ্যে কিছু অন্য কারণ 


বিএসএফ 

রবিবারের হাঙ্গামার ইন্ধন যোগায় বিএসএফ। কিছুদিন আগেই বিএসএফের জওয়ানরা মালদায় গুলি চালায় গ্রামবাসীদের উদ্দেশ্যে, যার ফলে একটা চাপা ক্রোধ বিএসএফের উপর স্থানীয় মানুষের অনেকদিন ধরেই ছিল। কালিয়াচক অঞ্চল বহু বছর ধরে চোরাচালান, আফিম চাষ, জাল নোট সহ একাধিক অপরাধের কেন্দ্র হিসাবে উঠে আসছে। স্থানীয় অপরাধী ও বিএসএফ - পুলিশ - স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে দহরম মহরমের ফলেই যে ফুলে ফেঁপে উঠছে চোরাচালান ও মাদকের কারবার তা স্থানীয় মানুষের কথায় স্পস্ট ভাবে প্রকাশ পেল। সেই বিএসএফ আবার স্থানীয় মানুষের উপর কারণে অকারণে অকথনীয় অত্যাচার চালায়। যে কারণে রবিবার মিছিলের আক্রোশ গিয়ে পরে ওই বিএসএফ জিপের উপর।

তৃণমূল কংগ্রেস ও বাটোয়ারার লড়াই 


গত কয়েক বছর যাবত, বিশেষ করে তৃণমূলের তথাকথিত পরিবর্তনের সরকার আসার পরে মালদার দক্ষিণ অঞ্চলে রমরমা বাড়ে আফিম চাষের এবং মাদক ও জাল নোট চোরাচালানের। শাসক দলের বিভিন্ন গোষ্ঠির নেতা এই অপরাধের সাথে জড়িত এবং অনেকেই এর কেষ্ট বিষ্টু, ফলে পুলিশ ও বিএসএফ কে ভাগ দিয়ে চুপ করিয়ে রাখা মুশকিল হয়নি। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে তৃণমূলের বিভিন্ন গোষ্ঠির মধ্যে দ্বন্ধ তীব্র হয় চোরাচালানের ভাগ বাটোয়ারা কে কেন্দ্র করে। এর ফলে গত দুই মাসে কালিয়াচক অঞ্চলে শাসক দলের দুই গোষ্ঠী সরাসরি সংঘর্ষে জড়িত হয় অন্তত পাঁচ থেকে ছয় বার। এই গোষ্ঠী সংঘর্ষে কালিয়াচকের মানুষ প্রত্যক্ষ ভাবে দেখেন রাস্তার উপর বোমাবাজি, গুলি বৃষ্টি, এবং গত মাসে এই গোষ্ঠী সংঘর্ষের ফলে প্রাণ যায় এক বহিস্কৃত তৃণমূল নেতার অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র পুত্রের। সেই খবর সমগ্র বাংলার সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হতেই পুলিশের উপর চাপ বাড়ে এই ঘটনার তদন্ত শুরু করার এবং পান্ডাদের গ্রেফতার করার বন্দোবস্ত করার।
মালদা জেলা প্রশাসনের চাপে কালিয়াচক থানা এই ঘটনাগুলির নৈপথ্যে থাকা চোরাচালান ও অন্যান্য অপরাধের উপর গড়িমসি করে তদন্ত শুরু করে এবং পুলিশের তদন্ত অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ায় তৃণমূলের অভ্যন্তরে আতঙ্ক বেড়ে যায়।

কালিয়াচক ঘটনার অন্তরালে তৃণমূল মদতপুষ্ট চোরাচালানকারী শক্তি 


আঞ্জুমান আহলে সুন্নাতুল জামাত যে মিছিলের ডাক দেয় তার উদ্দেশ্য ছিল উত্তর প্রদেশের উগ্রপন্থী হিন্দু মৌলবাদী নেতা কমলেশ তিওয়ারির মুসলমান ধর্মগুরু মুহাম্মদের উপর করা কটুক্তির প্রতিবাদ প্রদর্শন। অথচ কমলেশ তিওয়ারি এই মন্তব্য করেছিলেন গত ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে এবং তার পর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে, তিওয়ারি এখন উত্তর প্রদেশের লখনউ শহরে জেলে বন্দী, তাঁর উপর জাতীয় সুরক্ষা আইনের আওতায় মামলা হয়েছে। হঠাত করে এই সময়ে তিওয়ারির এক মাস আগে করা মন্তব্যের উপর মিছিল করা হলো তার জবাব কেউ দিতে পারেনি। তার সাথে একটা খটকা বড় ভাবে নাড়া দিচ্ছে যে এই অঞ্চলে এক একটি গ্রামে ৩০০-৪০০ পরিবার বাস করে, যার থেকে এত বিশাল বড় একটা মিছিল বের করে আনা কোনও রাজনৈতিক ঝান্ডার তলে সম্ভব হতো না, হয়তো বা যদি গনি খান চৌধুরী বেঁচে থাকতেন তাহলে হত। তাহলে কি ধর্মীয় ঝান্ডাটি রাজনৈতিক ঝান্ডা লুকোবার একটি প্রয়াস? একটি আন্তর্জাতিক সীমান্তবর্তী জেলা হওয়ার কারণে নদিয়া, মুর্শিদাবাদের সাথে মালদারও গুরুত্ব দেশের ও রাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থাগুলির কাছে প্রবল। কিন্তু একটি সংগঠন মিছিল করে দক্ষিণ মালদার কালিয়াচকে যে ৩০-৪০,০০০ লোক আনছে সে খবর কেন আই বি, স্পেশাল ব্রান্চ বা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর দফতরে ছিল না তাও আশ্চর্য করে।  

অনেকের মন্তব্য হলো যে অসাউদ্দিন বিশ্বাস সহ বহু তৃণমুল নেতা এখন পুলিশের নজরে রয়েছেন, পুলিশী তদন্ত শুরু হতেই এবং বিশেষত গোষ্ঠী দ্বন্ধের ফলে কিশোর খুনের পর থেকেই চাপ বাড়ছিল বিভিন্ন চোরাচালানকারী তৃণমূল নেতা ও কর্মীদের উপর। তদন্তের সমস্ত নথিপত্র কালিয়াচক থানায় থাকার সম্ভাবনা প্রবল এবং সেই থানারই কিছু বিশ্বস্ত লোকেরা এই সব খবর তৃণমূল মদতপুষ্ট চোরাচালানকারীদের জানায় এবং রবিবারের মিছিলে তৃণমূলের অনেক ছোট ও মাঝারি মাপের মুখ দেখা গেছে বলে খবর। কংগ্রেস সাংসদ আবু হাসেম খান চৌধুরী সংবাদ মাধ্যমে অভিযোগ করেন যে কালিয়াচকের ঘটনায় তৃণমূলের লোকেরাই মূল সাগরেদ এবং সেই কারণে পুলিশ অভিযুক্তদের আড়াল করছে। পুলিশ এর মধ্যে যাদের গ্রেফতার করেছে তাঁরা সবাই এলাকার ছোট খাটো অপরাধী হিসাবে পরিচিত কিন্তু সংগঠিত ভাবে হাঙ্গামা পরিচালিত করতে পারে সে কথা কেউ মানছেন না। যে দক্ষতার সাথে সাধারণ মানুষ ও যাত্রীদের নিরাপদে সরিয়ে বাসে ও গাড়িতে আগুন লাগানো হয়েছে তা যে স্বতস্ফুর্ত কান্ড এ কথা বলা যাবে না। থানায় আগুন জ্বলার ফলে যে অনেক নথি নষ্ট হয়ে গেছে সে কথা স্পষ্ট, তবে যেটা পরিষ্কার হয়নি তা হলো যে এবার পুলিশ ও প্রশাসন কি ভাবে অপরাধীদের ধরবে বা এই ঘটনার তদন্ত কি সত্যিই নিরপেক্ষ ভাবে করা যাবে। আমাদের মনে হয় না, কারণ সমস্ত ঘটনাক্রম ইঙ্গিত করছে যে পুলিশ যেনতেন ভাবে আসল কারণ কে চাপা দিয়ে পুঁটি মাছদের জালে নিয়ে রাঘব বোয়ালদের ছেড়ে দেবে।        

 

কালিয়াচকে দাঙ্গা লাগাবার পরিকল্পনা 


জিষ্ণু বসু, গোপাল তিওয়ারি এবং বেশ কিছু সংঘ প্রচারক রবিবারের মিছিলের হাঙ্গামার সময়ে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে পৌঁছে তীব্র সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করা শুরু করেন। মুসলমান পুরুষদের যৌন অঙ্গ কে নিয়ে কুরুচিকর মন্তব্য করে এই সংঘ প্রচারকরা আগুনে ঘি ঢালার চেষ্টা করে এবং স্থানীয় হিন্দু জনগণকে দাঙ্গা করে মুসলমান নিকেশ করার আহ্বান করে। যদিও স্থানীয় মানুষ আরএসএস এর প্ররোচনায় পা না দিয়ে অনেক ধৈর্য সহকারে এলাকায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ও সম্প্রীতি রক্ষা করার কাজ চালিয়ে যান। আরএসএস এর প্রচারকরা যখন দেখে যে তাঁদের দাঙ্গার ডাকে সারা দেওয়ার কে নেই তখন তাঁরা অনেকেই বিছিন্ন মারপিটে জড়িয়ে পড়েন এবং একজন প্রচারকের পায়ে গুলি লাগে। পরে সারা ভারতের আরএসএস প্রচারকরা এই খবর কে উপলক্ষ করে দাঙ্গা বাঁধাবার চেষ্টা চালিয়ে যায়।  এই সম্পর্কে আমি অন্য একটি প্রবন্ধ এই ব্লগে লিখেছি।             

কি ভাবে আরএসএস এর সন্ত্রাসবাদীরা মালদার ঘটনা কে কেন্দ্র করে দেশ জোড়া দাঙ্গা লাগাতে চাইছে জানতে হলে এই ব্লগ পোস্টটি পড়ুন।           


এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে