২রা সেপ্টেম্বরের দেশজোড়া শ্রমিক - কর্মচারীদের ধর্মঘট কে জিততেই হবে

সোমবার, আগস্ট ৩১, ২০১৫ 0 Comments A+ a-

২রা সেপ্টেম্বরের দেশ জোড়া শ্রমিক সংগঠনগুলির ডাকা সর্বভারতীয় সাধারণ ধর্মঘট কে ভাঙ্গার কথা প্রকাশ্যে ঘোষনা করে মমতা ব্যানার্জী সরাসরি মোদী নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের প্রতি তার নৈতিক সমর্থনের ইঙ্গিত দিলেন, তার সাথে তিনি তার স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে তাতিয়ে তুললেন তার ছাত্র পরিষদ কর্মী সমর্থক থুড়ি গুন্ডা বাহিনী কে যাতে তারা ৬০-৭০ এর দশকের যুব কংগ্রেস - ছাত্র পরিষদের মত সরাসরি বামপন্থী কর্মী সমর্থকদের উপর হামলা করে ধর্মঘট ভাঙ্গার কাজ করতে পারে। এই আস্ফালনের প্রেক্ষাপট হলো মমতার পুলিশের দ্বারা ২৭শে অগাস্ট নির্মম ভাবে নবান্ন অভিযানে সামিল কৃষকদের মিছিলের উপর দমন পীড়ন। একদিন মিছিল আটকে মমতা ও তৃণমূলী সরকারের স্থির বিশ্বাস হয়েছে যে তারা শ্রমিক ও কৃষকদের যে কোনও লড়াই ভাঙ্গতে পারবে তাদের দলদাস প্রশাসনকে লেলিয়ে দিয়ে।   

২রা সেপ্টেম্বরের দেশ জোড়া শ্রমিক - কর্মচারীদের ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল ডান - বাম মিলিয়ে ১১ টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন, কিন্তু ধর্মঘট থেকে শেষ মুহুর্তে আরএসএস এর চাপে পিছু হটে সংঘ পরিবারের শ্রমিক সংগঠন ভারতীয় মজদুর সংঘ। এই ধর্মঘট ডাকা হয়েছে মোদী সরকারের জন বিরোধী নীতিগুলির বিরুদ্ধে। গত এক বছর ধরে বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকার তার পূর্বসূরী কংগ্রেস সরকারের পথ ধরে চলে বড় বড় কর্পোরেটগুলির, বিদেশী বৃহত একচেটিয়া লগ্নি পুঁজি ও তার দেশী দালাল পুঁজির স্বার্থ রক্ষা করার জন্যে জনগণের ঘাড়ে নামিয়ে আনছে একের পর এক ভয়ানক কোপ।  যেমন শ্রম আইন সংস্কার করে দেশের শিল্প ক্ষেত্রে কর্মরত এক বিরাট অংশের শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলো। ন্যুনতম মজুরি বাড়ানোর যে সংগ্রাম সারা দেশব্যাপী মূল্য বৃদ্ধির বাজারে শ্রমিক শ্রেণী চালিয়ে আসছে তার প্রতি নির্মম পরিহাস করে লোক দেখানো ভঙ্গিতে যত সামান্য বাড়ানো হলো মজুরি, অন্যদিকে কর ছাড় সহ নানা সুযোগ সুবিধা দিয়ে মালিক শ্রেণীকে দেওয়া হচ্ছে অঢেল লাভ কামাবার উপায়।  ৮ ঘন্টার কর্মদিবস আউটসোর্সিং ও এসইজেড এর দৌলতে আগেই শ্রম দুনিয়া থেকে চলে গেছে অতীতের রক্ষনাগারে, এবার ১০-১২ ঘন্টার নিয়মিত কর্ম দিবস করার প্রয়াস চালানো হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণীকে ক্রীতদাসের মতন ব্যবহার করার স্বার্থে। ওভারটাইমের জায়গায় এখন নিয়মিত কর্মদিবসেই শ্রমিক ও কর্মচারীদের বেশি বেশি খাটিয়ে প্রচুর মুনাফা কামাবার লালসায় বৃহত একচেটিয়া লগ্নি পুঁজিপতিরা, তাদের ভারতীয় দালাল পুজিপতি ও তাদের পেটোয়া বাজারী সংবাদ মাধ্যমগুলি এই তথা কথিত শ্রম আইন সংস্কারের নামে শ্রমিকদের উপর শোষনের বোঝা ভারী করার ষড়যন্ত্র কে 'সাহসী পদক্ষেপ', 'বলিষ্ঠ পদক্ষেপ', ইত্যাদী বলে সাধুবাদ দিছে। 

দেশের বেসরকারী ক্ষেত্রে কর্মরত কর্মচারীদের অবস্থাও শ্রমিকদের মতনই অসহনীয় পর্যায় নেমে গেছে।  বিপুল মূল্যবৃদ্ধির বাজারে বিদেশী বৃহত একচেটিয়া পুঁজি ও তাদের তল্পিবাহকদের প্রতিষ্ঠানগুলিতে নিম্ন পদে কাজ করা কর্মচারীদের বেতন বাড়ছে যত সামান্য, অন্যদিকে ম্যানেজমেন্ট এর বেতন বাড়ছে হুহু করে। সরকারী কর্মচারীদের বেতন বাড়িয়ে, শূন্যপদে লোক নিয়োগ বন্ধ রেখে ঠিকা কর্মচারীদের দিয়ে পূর্ণ কর্মচারীদের বেতনের ১/১০ অংশ দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে, বেসরকারী ক্ষেত্রের মতন কোনও সুযোগ সুবিধা কর্মচারীদের দেওয়া হচ্ছে না। তার উপর শ্রমিক - কর্মচারীদের  সারা জীবন ধরে সঞ্চিত প্রভিডেন্ট ফান্ড এর টাকা এবার সরকারের পক্ষ থেকে বৃহত একচেটিয়া লগ্নি পুঁজি কে ভেট হিসাবে দান করা হচ্ছে শেয়ার বাজারে ফাটকা খেলার জন্যে। এর ফলে অবসরের পরে পথে নামবেন বহু শ্রমিক ও কর্মচারীরা, আর তাঁদের টাকা মেরে দিয়ে লালে লাল হবে এক শ্রেনীর ফাটকাবাজ পুঁজিপতি।      

এই পরিস্থিতিতে একদিকে মমতা যখন বৃহত এক চেটিয়া পুঁজির চাপে ও সারদা কেলেঙ্কারির ঠেলায় তার পুরানো মিত্র বিজেপির সাথে সন্ধি করেছেন গোপনে - ধরি মাছ না ছুই পানি - নীতি অবলম্বন করে এবং আক্রমণের তীর ঘুরিয়েছেন শ্রমিক কৃষকদের সংগ্রামের দিকে তখন স্পষ্টতই তার মন্তব্যের ও হুমকির মধ্যে দিয়ে এটা পরিস্কার হচ্ছে যে তিনি কাদের স্বার্থ রক্ষা করতে চান।  কেন তিনি শ্রমিক - কৃষক বিরোধী মোদী সরকারের অর্থনৈতিক নীতিগুলির আর খোলাখুলি বিরোধিতা করতে পারছেন না সে কথা তিনি স্পস্ট করে  বাংলার খেটে খাওয়া মানুষদের জানাতে দ্বিধা বোধ করছেন কেন ? তার ধর্মঘট বিরোধিতার অর্থই হলো যে তিনি খোলাখুলি ভাবে মোদী সরকারের কর্পোরেট তোষণ রাজনীতির পক্ষে দাঁড়ালেন, যেমন দাঁড়িয়েছিলেন বাজপেয়ীর সরকারের বিলগ্নীকরণ ও উদারীকরণের নীতির পক্ষে সেই ২০০০-২০০৪ সালে। কিন্তু শুধু মাত্র মুসলমান ভোট খুয়ে যাবার আতঙ্কে উনি এখনো সর্ব সমক্ষে বিজেপির সাথে হাত মেলাচ্ছেন না।  

মমতার সরকার কিছুদিন মুখে মুখে বিজেপির বিরোধিতা করলেও সংসদে অন্যান্য বিরোধীদের থেকে নিজেদের দূরত্ব বজায় রেখে দর কষাকষি চালিয়ে যায় বিজেপির বিরুদ্ধে।  তাই পেঁয়াজ সহ সমস্ত তরী তরকারী, চাল, ডাল, তেল সহ খাদ্য বস্তু ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের চরম মূল্যবৃদ্ধি সত্তেও তারা কোনও কেন্দ্র বিরোধী লড়াইয়ে জোট বাঁধেনি। রাজ্যের কোনও জায়গায় পেঁয়াজের কালোবাজারী রুখতে রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে সরকারী উদ্যোগে সঠিক দামে পেঁয়াজ বন্টনের ব্যবস্থাও মমতা ব্যানার্জীর সরকার করেনি। এরা ভাত দেওয়ার মুরোদ রাখেনা, কিন্তু কিল মারার গোঁসাইয়ের ভূমিকায় ভালো ভাবেই উত্তীর্ণ হয়।    
পশ্চিম বাংলায় একদিকে যখন আজ মূল্যবৃদ্ধির সূচক বেড়ে চলেছে, গরিব ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের হেঁসেল থেকে ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়েছে মাছ, মাংস, ডাল, ও সবুজ তরী তরকারী, কর্ম সংস্থানের সুযোগ কমায় লোটা কম্বল নিয়ে প্রবাসে যেতে বাধ্য হচ্ছে অসংখ্য তরুণ - তরুণী, অন্যদিকে যখন এই রাজ্যে অবস্থিত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলি, কর্পোরেট সংস্থাগুলি কলকাতা ও পশ্চিম বাংলাকে কোনও এক অজ্ঞাত কারণে 'কম খরচের জায়গার' নাম দিয়ে অন্যান্য রাজ্য ও শহরের তুলনায় প্রচুর কম বেতনে কর্মচারীদের দিয়ে একই রকমের কাজ করায় (যদিও দিল্লি ও কলকাতায় জীবন যাপন করার খরচায় কোনও তারতম্য নজরে পরেনি ডালহাউসি তে রাস্তায় সস্তার ভাত মাছ ছাড়া) তখন কিন্তু আমরা মমতার গর্জন শুনি না ওই বিদেশী একচেটিয়া পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে, তাদের দেশীয় মারোয়ারী - গুজরাটি - বাঙালি পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে। সমস্ত গর্জন আর হুমকি তিনি লুকিয়ে রাখেন শ্রমিক ও কৃষকদের, কর্মচারী ও ছাত্র যুবদের বিরুদ্ধে। তার কারণ, মমতার শ্রেণী স্বার্থ বিজেপির থেকে অভিন্ন, তার শ্রেণী স্বার্থ জড়িয়ে আছে জোতদার - জমিদার বিদেশী ও দেশী পুঁজিপতিদের সাথে।তাই শুনি প্রতিবার ধর্মঘট ভাঙ্গার হুমকি, শ্রমিক -কৃষক-ছাত্র-যুব-মহিলাদের সংগ্রাম দমনের হুঙ্কার।            

ধর্মঘট গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমিক শ্রেনীর এক অবিচ্ছেদ্য অধিকার, তাঁর গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের হাতিয়ার। এই অধিকার তাঁর থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না এবং কারুর চাপে সে নিজে থেকে এই হাতিয়ার সমর্পণ করবে না। আগামী ২রা সেপ্টেম্বর দেশ জোড়া ধর্মঘট সংগ্রামে বিপুল ভাবে শ্রমিক ও কর্মচারীরা অংশ গ্রহণ করে মোদী সরকারের কর্পোরেট তোষণের নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে নিজেদের দাবি জানাবেন এবং নিজেদের অধিকার কেড়ে নেওয়ার লড়াইতে তীব্র গতিতে এগিয়ে যাবেন।  মমতার পুলিশ, যুব তৃণমূল, তৃণমূলী ছাত্র পরিষদ, গুন্ডা বাহিনী, বোমা-গুলি-লাঠি কোনও কিছুই শ্রমিকদের ন্যায্য দাবির এই লড়াইকে রুখতে পারবে না। 

সেই ১৯৫৯ সালের ৩১শে অগাস্ট বিধান রায়ের কংগ্রেসী পুলিশ নির্মম ভাবে কলকাতার রাজপথে পিটিয়ে পিটিয়ে খুন করেছিল ৮৯ জন নিরীহ - ক্ষুদায় কাতর কৃষকদের, ২০১৫ সালের ২৭শে অগাস্ট মমতার তৃণমূলী পুলিশ পিটিয়ে আহত করলো নিরস্ত্র কৃষকদের, আর ২রা সেপ্টেম্বর লড়াই হবে শ্রমিকের আত্মসম্মান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সাথে মমতার বৃহত পুঁজির স্বার্থে শ্রমিকদের উপর ফ্যাসিস্ট দমন পীড়ন নামিয়ে আনার ষড়যন্ত্রের। এ হবে রাজপথে খোলাখুলি দুই শ্রেনীর, শোষিত ও শোষকের শ্রেণী যুদ্ধ, এবং এই লড়াইতে শ্রমিকশ্রেণী কে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম করে জিততে হবেই।              


এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে